অব্যবস্থাপনা ও জনবলসংকট মেডিক্যাল স্টোর না থাকায় জীবন রক্ষাকারী ওষুধ রাখা হচ্ছে বারান্দা ও সিঁড়ির নিচে এভাবে সংরক্ষিত ওষুধ খেয়ে ফলাফল আসে না :অভিমত ওষুধ প্রযুক্তিবিদদের সিঁড়িঘরের মেঝেতে ময়লা পানি। তার মধ্যে রাখা হয়েছে জীবন বাঁচানোর ওষুধ। বুধবার সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ছবিটি তুলেছেন সামসুল হায়দার বাদশা আবুল খায়ের০৭:১৫, ০৮ জুলাই, ২০২১ | পাঠের সময় : ৫ মিনিট রাজধানীর কাছেই সাভারে সরকারি উপজেলা হাসপাতালে জনবল সংকটসহ চিকিৎসা সেবার চরম অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের পাশাপাশি অনেক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সাভার এলাকা দিয়ে যাতায়াত করলেও দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সেখানকার চিকিৎসা সেবার বেহাল দশা যেন দেখার কেউই নেই। শুধু সাভার নয়, সারাদেশের ৪৯২টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন পর্যায়ের উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও ওয়ার্ড পর্যায়ের হেলথ কমিউনিটি ক্লিনিকে চিকিৎসা সেবায় অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, তৃণমূল পর্যায়ে চিকিৎসা সেবার এই বিশাল অবকাঠামো পুরোপুরি সচল থাকলে এবং সঠিকভাবে কাজ করলে সাধারণ রোগীদের পাশাপাশি মহামারীকালের করোনা রোগীরাও সুচিকিৎসা পেতেন। যেহেতু টিকার সংকট, তাই জ্বর, সর্দি, কাশি ও গলায় ব্যথা-করোনা এসব উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা ওয়ার্ড, ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে প্রটোকল অনুযায়ী প্রাথমিক ট্রিটমেন্ট দিলে ভাল হয়ে যায়। তাই তৃণমূলের সকল স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো জনবল নিয়োগসহ সচল রাখার পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে এসব চিকিৎসা কেন্দ্র উপসর্গভিত্তিক প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে জনগণকে সচেতন করা গেলে করোনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করেন। মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ও সিভিল সার্জনরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন পর্যায়ে উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও ওয়ার্ড পর্যায়ের হেলথ কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো নিয়মিত মনিটরিং ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলে সারাদেশে স্বাস্থ্য সেবার এই অব্যবস্থাপনা থাকতো না। বুধবার বেলা পৌনে ২টায় ইত্তেফাকের এই প্রতিনিধি সরেজমিন সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে চিকিৎসা সেবার অব্যবস্থাপনার চিত্র দেখতে পান। হাসপাতালটি বাইরে থেকে অনেক সুন্দর দেখা গেলেও ভিতিরে নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। ডাক্তারদের উপস্থিতি ছিল কম। জনবলেরও সংকট আছে। ডাক্তারসহ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী সংকট রয়েছে দীর্ধদিন ধরে। অপারেশন থিয়েটার ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও সিজারিয়ান অপারেশন ছাড়া অন্য কোন অপারেশন হয় না। জেনারেল সার্জন পদে কেউ নেই। মেডিক্যাল অফিসার (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. আরমান আহমেদ বলেন, এখানে শুধু সিজারিয়ান অপারেশন হয়। মেডিক্যাল স্টোর না থাকায় জীবনরক্ষাকারী ওষুধ রাখা হয়েছে খোলা জায়গায়, বারান্দায় ও সিঁড়ির নিচে। এতে ওষুধের গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে। শুধু সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নয়, সারাদেশের ৪৯২টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই ওষুধ সামগ্রী রাখার স্ট্রোর নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. একে লুত্ফুল কবীর বলেন, বাতাসের সংস্পর্শে অক্সিজেন আছে। ওষুধের মধ্যে কেমিক্যাল আছে। বাতাস ও ওষুধের সংস্পর্শ হলে একটি প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। তখন ওষুধের গুণগত মান ঠিক থাকে না। এই সংরক্ষণে রক্ষিত ওষুধ খেলে রোগীদের কোন ফলাফল আসবে না। কোন কোন ক্ষেত্রে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও হতে পারে। তিনি বলেন, ওষুধ সংরক্ষণের স্বাভাবিক তাপমাত্রা হলো ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি। আমাদের দেশে এখন ৪০ ডিগ্রি পর্যন্ত তাপমাত্রা থাকে। বর্তমানে বৃষ্টিতে সাঁতসেঁতে পরিবেশ। এই পরিবেশে খোলা জায়গায় ওষুধ সংরক্ষণ করা ঠিক না। এক্ষেত্রে কয়েক দিনের মধ্যে ওষুধের গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়। তাপমাত্রা সংবেদনশীল না হলে ওষুধের গুণগত মান থাকার কথা না। রোগীদের জীবন রক্ষার্থে ওষুধ সংরক্ষণের যে নিয়ম-নীতি আছে তা অনুসরণ করেই ওষুধ সংরক্ষণ করতে হবে। নইলে ওষুধ খেয়ে হিতে বিপরীত হবে। সাভার উপজেলা হাসপাতালটি যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন সেখানে জনগণ ছিল ৩ থেকে ৪ লাখ। বর্তমানে সাভারে ৫০ লাখ মানুষের বসবাস। এই উপজেলায় ১২টি ইউনিয়ন আছে। সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায়, উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসার বেল্লাল জরুরি বিভাগে এক আহত ব্যক্তির সেবা ও ড্রেসিং করছিলেন। তবে এই হাসপাতালের এক শ্রেণীর ডাক্তার ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তারা দালালদের মাধ্যমে প্রাইভেট ক্লিনিকে রোগী ভাগিয়ে নেন। বেশিরভাগ অপারেশন ডাক্তাররা তাদের প্রাইভেট চেম্বারে করান। বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক আছে দুই শতাধিক। এরমধ্যে ২৮টি বৈধ। দালালদের সাথে ডাক্তারদের যোগসাজসে রোগীদের নিয়ে যাওয়া হয় বেসিরকারি ক্লিনিকে। প্রায়ই করোনা রোগীরাও অপদস্ত হচ্ছেন। করোনা রোগীদের জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৬টি আইসোলেশন বেড আছে। গৃহবধূ শাহিদা আক্তার সাভার পৌরসভার নামাগেন্ডা এলাকার বাসিন্দা। গর্ভবতী শাহিদা পেটের ব্যথা নিয়ে কিছুদিন আগে সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগে যান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে বের করে দিয়ে বলেন, এখানে কোন চিকিৎসা হয় না। শাহিদার স্বামী যে মালিকের গাড়ি চালক, তার সহযোগিতায় বেসরকারি একটি ক্লিনিকে পেটে ব্যথার চিকিৎসা নেন। একইভাবে দিনমজুর শফিকুল ইসলাম হঠাৎ পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হন এক সপ্তাহ আগে। সাথে সাথে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ইমার্জেন্সি বিভাগে চিকিত্সা সেবার জন্য গেলে তাকে ডাক্তাররা ছুঁয়েও দেখেনি। পরে বেসরকারি একটি হাসপাতালে তাকে চিকিৎসা নিতে হয়েছিল। সাভার উপজেলায় ৩৭টি কমিউনিটি ক্লিনিক ও ২টি উপ-স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আছে। এরমধ্যে সাভার আমিনবাজার এলাকায় ২০ বেডের হাসপাতাল সরেজমিন পরিদর্শন করেন ইত্তেফাকের এই প্রতিনিধি। সেখানে স্বাস্থ্য কেন্দ্রটি তালা দেওয়া ছিল। এই স্বাস্থ্য কেন্দ্রে শুধু আউটডোর খোলা আছে। ২০ বছর আগে সারাদেশে ২০০টি ইউনিয়ন পর্যায়ে ২০ শয্যার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু কোন জনবল দেয়নি। শুধু স্থাপনা নির্মাণ করে কোটি কোটি টাকা খরচ করে এগুলো প্রতিষ্ঠা করা হয়। সাভার আমিনবাজারের উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ডাক্তার, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের থাকার জন্য পৃথক কোয়ার্টার আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মচারীরা এসব কোয়ার্টারে থাকছেন। কোয়ার্টারে অবস্থানকারী একজন পরিচয় দেন, তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লিফট অপারেটর। বুধবার সরেজিমন পরিদর্শনে গিয়ে সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ডা. সায়েমুল হুদাকে কর্মস্থলে পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সিভিল সার্জন অফিসে মিটিংয়ে আছেন। আলাপকালে ডা. সায়েমুল হুদা সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য সেবার মান অন্যান্য হাসপাতালের চেয়ে ভাল বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, করোনা রোগী বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে সাভার আমিনবাজারের উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রটি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল করার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, লাইন ডাইরেক্টর ও সিভিল সার্জনের কাছে লিখিতভাবে বলা হয়েছে। কিন্তু কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। এদিকে সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও) সাইদুল ইসলামকেও গতকাল কর্মস্থলে পাওয়া যায়নি। ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তার এক আত্মীয় অসুস্থ থাকায় তিনি সেখানে গেছেন। ঢাকা জেলা সিভিল সার্জন ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান বলেন, সারাদেশে কোথাও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিক্যাল স্টোর নেই। এ কারণে ১০/১৫ দিনের মতো ওষুধ হাসপাতালে রাখা হয়। পরবর্তীতে আবার দেওয়া হয়। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একটি মেডিক্যাল স্টোর থাকা প্রয়োজন। জনবল সংকটের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, জনবল দেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. মো. বেল্লাল হোসেন বলেন, জনবল সংকট আছে। জনবল সংকটের নিরসন করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালককে (প্লানিং) লিখিতভাবে জানিয়েছি। এছাড়া বিভিন্ন অভিযোগের ব্যাপারে তিনি খোঁজ-খবর নেবেন বলে জানান। ইত্তেফাক/বিএএফ