‘রাত তিনটা, চাচির শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকে। এর মধ্যে একটা নাম্বার থেকে আবার কলব্যাক করে, আর্জেন্ট হলে অক্সিজেন দেওয়া যাবে, অনেক অনুনয়-বিনয় করে চাইলাম, রাজি হলো। কিন্তু খালি সিলিন্ডার নেবে না, ভরা সিলিন্ডার রিসিভ করবে শর্তে। হাসপাতালের পলিটিকস না বুঝে রাজি হয়ে যাই। বলল ১৫ মিনিটে অক্সিজেন হাসপাতালের সামনে আসবে, খুশিতে দৌড়ে হাসপাতালে চলে যাই।’ ‘সেখানে বাধে সিন্ডিকেট ব্যবসা। যেখানে রোগী মরুক বাঁচুক, দেখার বিষয় না। তারা অন্য ডিলার থেকে আনে বলে একই কম্পানির সিলিন্ডার হলেও এটা রিসিভ করবে না, ওদের সিলিন্ডারও দেবে না। পরে তারা অক্সিজেনগুলো অন্য হাসপাতালে দিয়ে দেয়, অসহায়ের মতো চেয়ে থাকি, আবার দৌড়ে পেছন পেছন যাই, সেখানে গিয়ে একটা অক্সিজেন খুঁজি, তারা জানায় তাদের হাসপাতালে অক্সিজেন শেষ, রোগীদের অবস্থা খারাপ। স্বার্থপর হতে পারলাম না, নিজের চাচিকে বাঁচাতে অন্যের জীবন রিস্কে ফেলব না ভেবে ফিরে আসি।’ ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার পাইকপাড়ার সমাজকর্মী জেবিন ইসলামের ফেসবুক স্ট্যাটাস এটি। জেবিন ইসলামের চাচি শাহেদা ইসলাম করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন গত শুক্রবার (২৩ জুলাই) সকালে ঢাকার ধানমণ্ডি ক্লিনিকে। পাইকপাড়ার আজিজ মঞ্জিলের মো. জহিরুল ইসলামের সহধর্মিণী তিনি। শাহেদা ইসলামের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার শুরু থেকে মৃত্যু পর্যন্ত অবস্থা নিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন জেবিন ইসলাম। ওই লেখায় ফুটে উঠেছে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার বর্তমান চিত্র। আর এ চিত্র থেকে শিক্ষা নেওয়ার আছে অনেক কিছু। জেবিন ইসলাম লিখেছেন, তাঁর চাচির প্রথমে জ্বর হয়। চিকিৎসকের পরামর্শে বাসায় সেবা চলে। চতুর্থ ও পঞ্চম দিন জ্বর দিয়ে দাঁড়ায় ১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইটের ওপরে। চিকিৎসকের পরামর্শে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে নেওয়া হয় বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানে একাধিক ইনজেকশন দেওয়া হয়। ঈদের কারণে একদিন বাসায় আনার পর অক্সিজেন সেচুরেশন কমে আসায় আবার হাসপাতালে নেওয়া হয়। ঈদের পরের দিন অক্সিজেন লেভেল ৭৪-এ নেমে আসে। এক ঘণ্টা টানা কাশির পর রাত প্রায় ১২টায় তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। ডাক্তার হাই ফ্লো অক্সিজেন দিয়ে দ্রুত ঢাকা নেওয়ার জন্য বলেন। জেবিন ইসলাম তাঁর স্ট্যাটাসে উল্লেখ করেছেন, এরপর থেকেই শুরু হয় নানা ধরনের সমস্যা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানাল, তাদের অক্সিজেনসংকট। শাহেদা ইসলামকে দেওয়া অক্সিজেনটাই তাদের শেষ। ঢাকায় নিতে হলে একাধিক অক্সিজেন সিলিন্ডার প্রয়োজন বলে সরবরাহের অনুরোধ করে গভীর রাতে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া হয়। সেখান থেকে পাওয়া বিনা মূল্যে অক্সিজেন দেওয়ার ২৪ ঘণ্টা সার্ভিসের একাধিক ফোন নম্বরে যোগাযোগ করেও ব্যর্থ হতে হয়। অনেকে ফোন ধরেননি, অনেকে বলেছেন পর্যাপ্ত অক্সিজেনের ব্যবস্থা নেই, অনেকে বলেন সকাল ছাড়া দেওয়া সম্ভব নয়। জেবিন ইসলাম লেখেন, ‘এদিকে চাচির কষ্ট বাড়তে থাকে, সামান্য একজন স্টাফকে পারছিলাম না পায়ে ধরি, কিন্তু সে তার কথায় অটল। এই হাসপাতাল অন্য ডিলার থেকে অক্সিজেন আনে, তাই এগুলো এই হসপিটালে রাখা যাবে না। আমার ছটফট দেখে একটা ছোট ছেলে, ওই হসপিটালেরই স্টাফ, জানায় আমি খালি সিলিন্ডার দেব, আপনি শুধু অক্সিজেনের ব্যবস্থা করেন। আনন্দে মনটা ভরে গেল, আবার ফোন করে রিকোয়েস্ট করলাম, ফজরের আজান দিচ্ছিল, তারা ছয়টা অক্সিজেন নিয়ে এলো। তারপর ওই অমানুষ স্টাফকে বললাম, জীবনে যদি নিজের বাবা-মা ও আপনজনদের অক্সিজেনসংকট হয় ওই দিন বুঝবেন আপনি কত খারাপ মানুষ!’ অ্যাম্বুল্যান্স আনতে গিয়েও বিড়ম্বনার কথা উল্লেখ করেছেন জেবিন ইসলাম। হাসপাতালের সাইনবোর্ড থেকে দেখে কিছু ফোন নম্বর সংগ্রহ করে ভোর পাঁচটায় কল করা হলে অনেকেই কেটে দেন। পরে এক পরিচিতজনের মাধ্যমে অ্যাম্বুল্যান্স সংগ্রহ করা হলো। তিনি লিখেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ঢাকায় পৌঁছা হয় মাত্র দুই ঘণ্টায়। যাওয়া হয় ডিএনসিসিতে। কিন্তু সেখানের অবস্থা ভয়াবহ খারাপ। দুইটা নরমাল বেড খালি, তা-ও আগের রাতে দুজন মারা যায় বলে। বেড থেকে ওয়াশরুমের দূরত্ব মিনিমাম ১০০০ ফুট। ওই সময়টা চাচির সবচেয়ে কষ্টে কাটে। তাৎক্ষণিক আইসিইউ লাগবে মাস্ট। পরিচিতজনের মাধ্যমে যাওয়া হয় ধানমণ্ডি ক্লিনিকে। কিন্তু মাত্র পাঁচ মিনিটে ভর্তি করা ডিএনসিসি হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ হওয়ার ফরমালিটি আর ট্রলি ম্যানেজ করতে প্রায় ঘণ্টা দেড়-দুই লেগে যায়। প্রতিটা সেকেন্ড কাউন্টেবল ছিল। বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ধানমণ্ডি ক্লিনিকে শাহেদা ইসলামকে নেওয়া হয়। সন্ধ্যা সাতটার দিকে ওনাকে লাইফসাপোর্টে দেওয়া হয়। পরদিন সকালে ডাক্তাররা জানান, তিনি মারা গেছেন। এরই মধ্যে ওনার কভিড শনাক্ত হয়। আক্রান্তের রেকর্ড গত বছরের এপ্রিল মাসে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার ১৫ মাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মৃত্যুর সংখ্যা ২৬ জুলাই পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৮৭ জনে এবং আক্রান্তের সংখ্যা ৬৬০৯ জন। সেই হিসাব মতে, প্রতি মাসে গড়ে ছয়জন মারা যান ও আক্রান্ত হন প্রতিদিন ১৪ জন। তবে চলতি জুলাইয়ের হিসাবে চোখ ছানাবড়া হওয়ার পালা। গত ২৬ দিনে প্রতিদিন গড়ে ৯২ জনের মতো আক্রান্ত হচ্ছেন, মারা গেছেন ২৫ জন। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে অন্তত একজন করে মারা যাচ্ছেন। আক্রান্তের হার বেড়ে প্রায় ৩৬ শতাংশ। সোমবার রেকর্ড ১৮৪ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এদিকে করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রতিদিন বাড়তে থাকলেও সুবিধা বাড়েনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। একমাত্র আইসোলেশন সেন্টার ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে এখনো সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট স্থাপন কাজ শেষ হয়নি। কোয়ারেন্টিন সেন্টার করায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিক্যাল কলেজে এখন আইসোলেশনের ব্যবস্থা নেই। জেনারেল হাসপাতালে বর্তমানে ৭৫ জনের আইসোলেশনের ব্যবস্থা আছে। খোঁজ নিয়ে ও জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানায়, গত বছরের এপ্রিল মাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে মজনু মিয়া নামে একজনের প্রথম করোনা শনাক্ত হয়। ওই মাসেই নাসিরনগরে প্রথম মারা যায় শাহ আলম নামে প্রবাসফেরত করোনা রোগী। গত বছরের জুনে এক মাসে সর্বোচ্চ ১৫ মারা যাওয়ার রেকর্ড হয়। এ বছর চলতি মাসের প্রথম ১৫ দিনেই ১৪ জন মারা গেছেন। আক্রান্ত হয়েছেন এক হাজার জনের বেশি। স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে পাওয়া হিসাব মতে ও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলায় মোট ২৫০ জনকে আইসোলেশনে রাখার ব্যবস্থা আছে। তবে এখন শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে ২৫ জনের মতো ভর্তি আছেন। ১০০ শয্যার আইসোলেশনের ব্যবস্থা থাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিক্যাল কলেজের শয্যাগুলো কোয়ারেন্টিনের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। উপজেলা সদরের হাসপাতালগুলোতে আইসোলেশনের ব্যবস্থার কথা বলা হলেও কোনো রোগী ভর্তি নেই। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হতে থাকলেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের ঘাটতি রয়েছে। ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট স্থাপন কাজ এখনো শেষ হয়নি। রোগীদের উচ্চমাত্রায় অক্সিজেন সরবরাহের জন্য হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলাও নেই। এ ছাড়া আক্রান্ত রোগীর ফুসফুস কত শতাংশ পর্যন্ত সংক্রমিত হয়েছে, সেটি জানার জন্য সিটি স্ক্যান ও পোর্টেবল এক্স-রে সুবিধাও নেই জেনারেল হাসপাতালটিতে। এর ফলে আক্রান্ত রোগীদের শারীরিক অবস্থা খারাপ হলে তাদের ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই কর্তৃপক্ষের। হাসপাতালের স্টোরকিপার সূত্রে জানা গেছে, সেখানে বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩৪ হাজার লিটার অক্সিজেন লাগে। সাধারণ সময়ে হাসপাতালে ১৬ হাজার ৩২০ লিটার অক্সিজেনের চাহিদা ছিল। স্প্রেক্টা ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড নামে একটি কম্পানি হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিক্যাল কলেজের চেয়ারম্যান ডা. মো. আবু সাঈদ বলেন, ‘আমার এখানে এখন ১০০ জনের জন্য শুধু ভারত ফেরত যাত্রীদের কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা আছে। একসঙ্গে দুটি চালানো সম্ভব নয়। তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় আবার এটাকে আইসোলেশন সেন্টার করা যেতে পারে।’ জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান জানান, সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। হাসপাতালে পর্যাপ্ত পরিমাণ অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে। সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্লান্ট স্থাপনের কাজ চলতি মাসেই শেষ হবে। তখন হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা ব্যবহার করা যাবে। আপাতত ম্যানিফোল্ড পদ্ধতিতে অক্সিজেন সরবরাহ করা হচ্ছে। হাসপাতালে বর্তমানে ২০০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে। আরো ৫০টি সিলিন্ডারের চাহিদাপত্র দেওয়া হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিভিল সার্জন ডা. মো. একরাম উল্লাহ জানান, করোনা রোগী বেড়ে গেলে আইসোলেশনের শয্যাসংখ্যা প্রয়োজনে আরো বাড়ানো হবে। তিনি জানান, খুব কমসংখ্যক রোগীর আইসিইউ ও হাই ফ্লো অক্সিজেন লাগে। জেলা সদর ও উপজেলা হাসপাতালে তিনটি করে অক্সিজেন কনসেনট্রেটর আছে। এই রকম আরো খবর