vimarsana.com


শ্রদ্ধা আর ঘৃণা। এই দুটি অনুভূতি আমার কাছে সবচে গুরুত্বপূর্ণ। বাকি বেশিরভাগ অনুভূতির সঙ্গেই লাভ-লোকসানের তীব্র হিসেব জড়িয়ে থাকে বলে সেসবের গুরুত্ব কম। ব্যক্তিগত ভাবেই অন্তত তীব্র ঘৃণা বয়ে বেড়ানো আমার কাছে খুব সুখকর কিছু নয়। ঘৃণিত প্রাণিদের তালিকাটিও তাই খুব দীর্ঘ নয় আমার। সেই তালিকার একজনকে ঘিরে এই লেখাটি।
নিজের যোগ্যতাতেই তালিকার একেবারে প্রথমদিকে সে নিজের নাম নিতে পেরেছে! তার নাম এডল্ফ হিটলার।
শূন্য থেকে কমবেশি এক দশকে একটি দেশের একনায়ক হয়ে যাওয়া খুব সহজ নয়। অ্যাডল্ফ হিটলার এই কাজটি খুব সাফল্যের সঙ্গে করেছিল। বক্তৃতা দেয়ার অসম্ভব ভালো গুণ ছিলো তার মধ্যে। মানুষের ভাবনায় নিজের স্থান করে নেয়ার গুণটিও। তার বক্তৃতা শুনে তার ভক্ত হয়ে ওঠেনি এরকম লোকের সংখ্যা নিতান্তই কম। তবে এই পশুটির অদ্ভুত এই ক্ষমতার সঙ্গে ছিল তার অসুস্থতাও। মানসিক ভাবে সে শিশুকাল থেকেই অসুস্থ ছিল। সেই কাহীনিটি খুব চমকপ্রদ। অন্তত মনোবিজ্ঞান যাদের পছন্দ তাদের জন্য তো বটেই। তবে সেই গল্পটি আজকে নয়। আজকে এই পশুটিকে হত্যার গল্প করতে চাই।
বিশেষ কিছু কারণে হিটলার নিজেকে দৈব ক্ষমতার অধিকারী ভাবত। সে বিশ্বাস করত জার্মানির মুক্তি আনতে তার জন্ম হয়েছে। তাকে সবসময় সাহায্য করছে অলৌকিক শক্তি। এই বিশ্বাসটি তৈরি হওয়ার পেছনে আছে তার মনোস্তাত্বিক ইতিহাস। সেই ইতিহাসটি ছাড়াও আর যে বড় একটি কারন তার এই বিশ্বাসটিকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শক্ত করেছে সেটি হত্যা চেষ্টা থেকে তার অলৌকিক ভাবে বেঁচে যাওয়ার ইতিহাস। জানামতে অন্তত ৪২ বার হিটলারকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। সব বারই বেঁচে যায় এই প্রাণিটি। এসব হত্যা চেষ্টার মধ্যে সবচে বিখ্যাত সম্ভবত ২০ জুলাই প্লট নামে খ্যাত কর্ণেল ক্লাউস ফন স্টাউফেনবার্গ পরিকল্পিত হত্যা চেষ্টাটি।
সঙ্গত কারণেই হিটলারের উত্থানের সময়ে তার ভক্ত হয়ে ওঠা অনেক সৈনিকই পরবর্তিতে তার কাজের সমর্থক হয়ে উঠতে পারেনি। স্টাউফেনবার্গও প্রথম পর্যায়ে হিটলারের অনুসারি হলেও পরবর্তীতে তার নৃশংসতা দেখে স্তব্ধ হয়ে যান। তিনি বুঝতে পারেন মানুষের ইতিহাসের সবচে নৃশংস প্রাণিটিকে হত্যা করাই মানুষকে আর সেই সঙ্গে জার্মনিকেও বাঁচানোর একমাত্র উপায়!
১৯৪৩'র এপ্রিলে স্টাউফেনবার্গ ছিলেন আফ্রিকার রণক্ষেত্রে (মরুর শিয়াল নামে খ্যাত রোমেল এর বাহিনীতে)। ৭ই এপ্রিল ব্রিটিশ বোমারু বিমানের হামলায় তিনি প্রায় মরতে মরতে বেঁচে যান। হারান বাম চোখ, ডান হাত এবং বাম হাতের দুটি আঙুল। এই ঘটনার জন্য তিনি সামরিক ভাবে পুরস্কৃত হন। তবে সবচে বড় যে ব্যপারটি ঘটে সেটি হচ্ছে নিবেদিত প্রাণ সৈনিক হিসেবে স্টাউফেনবার্গ দারুণভাবে হিটলারের বিশ্বস্থতা অর্জন করেন। যে অল্প কিছূ মানুষের হিটলারের নিকটে যাওয়ার অনুমতি ছিল তিনি তাদের একজন হয়ে দাঁড়ান। ততদিনে তিনি "রেজিস্টেন্স মুভমেন্ট" এ সক্রিয় হয়েছেন।
এই সময়ে রেজিস্টেন্স মুভমেন্টের লক্ষ্য অবশ্যই ছিল হিটলারকে হত্যা করা। কিন্তু সেই সঙ্গে হিটলারকে হত্যার পর কী ঘটতে পারে সেটাও একটা বড় প্রশ্ন হয়ে ছিল সবার সামনে। শুধু হিটলারকে হত্যা করলেই জার্মানির ভাগ্য বদলে যায় না। হিটলার পরবর্তী যাদের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা ছিল (বিশেষত হিমলার) তারাও হিটলারের আদর্শে বিশ্বাসী ছিল। ছিল হিটলারের মতই শ্বাপদ! ২০শে জুলাই প্লটের পরিক্লপনা ছিল তাই দুটি। প্রথমত হিটলারকে হত্যা করা এবং দ্বিতীয়ত এমন ভাবে ক্ষমতার হস্তান্তর যেন সেটি যুদ্ধ থামাতে কার্যকর ভূমিকা রাখে!
যুদ্ধ থামানোর জন্য প্রয়োজন ছিল হিটলারের সঙ্গে তার পরবর্তী কাছের যুদ্ধোন্মাদদেরও হত্যা করা। এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়া। প্রয়োজন ছিল নাজি আদর্শে গড়ে ওঠা জার্মান এসএস (শুথ্সটাফেল) বাহিনীকেও নির্বিষ করে ফেলা। স্টাউফেনবার্গের পরিকল্পনায় ছিল অপারেশন ভালকুয়েরি (Valkyrie. জার্মান: Walküre)। এই অপারেশনের ব্যবস্থাটি অবশ্য হিটলারেরই সৃষ্টি। এই ব্যবস্থাটি করার উদ্দেশ্য ছিল যেন বিপদের সময়ে জার্মান চেইন অফ কমাণ্ড টিকে থাকে। টিকে থাকে সরকার। একটি বিশেষ বাহিনী এজন্য প্রস্তুত থাকতো সবসময়। অপারেশন ভালকুয়েরিতে তাদের ক্ষমতা ছিল সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়ার। যে কাউকে গ্রেপ্তার করার। স্টাউফেনবার্গের পরিকল্পনা ছিল অপারেশন ভালকুয়েরির মাধ্যমে শীর্ষ নাজি নেতা, এসএস সদস্যদের গ্রেপ্তার করা এবং বড় শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়া। আর সেই কাজটি করার জন্য সবার আগে প্রয়োজন ছিল হিটলারকে হত্যা করা।
হিটলারকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয় উল্ফস লেয়ারে (নেকড়ের গুহা?)। উল্ফস লেয়ার ছিল হিটলারের মিলিটারি হেড কোয়ার্টারগুলোর একটি (বর্তমান পোল্যান্ডে অবস্থিত)। আয়তন ২ বর্গ কিলোমিটার। এটি ভাগ করা ছিল তিনটি সুরক্ষা বলয়ে। তিনটি বলয়ই ছিল আলাদা আলাদাভাবে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বেষ্টিত। পুরো এলাকাটি ছিল দারুণভাবে ভূমি মাইন, মেশিনগান পোস্ট এবং বিমান বিধ্বংসী স্থাপনা দিয়ে ঘেরা। এর ভেতরেও হিটলারের বিশেষ বাঙ্কারটি ছিল ১৬ ফুটেরও বেশি পুরু দেয়ালে আবৃত। স্টাউফেনবার্গ সেখানে একটি সামরিক মিটিংয়ে হিটলারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। সঙ্গে নিয়ে যান দুটি এক কেজি ওজনের প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ এবং ব্রিটিশদের ব্যাবহৃত কয়েকটি রাসায়নিক টাইম পেন্সিল। (পেন্সিলের মতো এই ডেটোনেটরগুলোর পেছনের রহস্য দারুণ মজার। কিন্তু এখানে সেটির বর্ণনা না দেয়াটাই ভালো হবে।)
শেষ মুহূর্তে হঠাৎ মিটিংয়ের স্থান বদল করে হিটলার। ভুগর্ভস্থ বাঙ্কারের বদলে মিটিং হয় মাটির উপরের একটি কনফারেন্স রুমে। মিটিংটি শুরুর আগ মুহূর্তে স্টাউফেনবার্গ তার দুটি বোমার একটিতে ডেটোনেটর ঢুকাতে পারেন। অন্য বোমাটিতে ডেটোনেটর প্রবেশ করানোর আগেই তার ডাক পড়ে যায় মিটিংয়ে। দুটি বোমারই অবশ্য প্রয়োজন ছিল না। একটি বোমাই যথেষ্ট ছিল মিটিংরুমে হিটলারকে হত্যা করার জন্য। স্টাউফেনবার্গ শক্তভাবে নিশ্চিত হবার জন্যেই দুটি বোমা নিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত সেই একটি বোমা নিয়েই তিনি কনফারেন্স রুমে প্রবেশ করেন। বোমার ব্যাগটি রাখেন যে টেবিলে আলোচনা চলছিল সেটির নিচে। হিটলারও সেখানেই ছিল। বোমার ব্যাগটি থেকে মাত্র কয়েক ফুট দূরে। একটু পরেই স্টাউফেসবার্গ কোনো একটি অজুহাত দেখিয়ে ঘরের বাইরে চলে আসেন। তার সামনেই বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের ব্যপকতায় স্টাউফেনবার্গ নিশ্চিত হয়ে যান হিটলার মারা গেছে। ওরকম একটি বিস্ফোরণের ধাক্কা সামলে বাঁচা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। এটি ২০ জুলাই ১৯৪৪ সালের ঘটনা।
বিস্ফোরণের পর স্টাউফেনবার্গ খুব দ্রুত অপারেশন ভালকুয়েরির তত্ত্বাবধানে চলে যান বার্লিনে।
বোমার বিস্ফোরণে ঘরের জানালা উড়ে যায়, দেয়ালের একাংশ ধ্বসে পড়ে, মেঝে এবং ছাদ ফেটে খসে পড়তে থাকে, আলোচনার টেবিলটিও চৌচির হয়ে যায়। খুব আশ্চর্যজনকভাবে হিটলারের বলতে গেলে কিছুই হয়না। এই ঘটনার জন্যে দুটি কারণের কথা বলা হয়ে থাকে। প্রথমত শেষ মুহূর্তে হিটলারের মিটিং রুমের পরিবর্তন। যে বিশেষ বদ্ধ বাঙ্কারে মিটিংটি হবার কথা সেটি বদলে অপেক্ষাকৃত বিশাল খোলামেলা কনফারেন্স রুমে চলে যাওয়া। এই কারণে অপেক্ষাকৃত ছোট এবং বদ্ধ বাঙ্কারে বোমা বিস্ফোরণে যেরকম ক্ষয়-ক্ষতি হবার কথা সেটি না হয়ে বরং অনেকটা কম হয়। এবং দ্বিতীয়ত, যে কনফারেন্স টেবিলটিতে আলোচনা চলছিল সেটির পুরুত্ব বোমার আঁচ থেকে হিটলারকে রক্ষা করে। টেবিলটি চৌচির হয়ে গেলেও বেঁচে যায় হিটলার।
বিস্ফরণের পর কনফারেন্স রুম। ছবিসূত্র উইকিপিডিয়া।
হিটলারের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে অপারেশন ভালকুয়েরি ব্যর্থ হয়। গেপ্তার হন স্টাউফেনবার্গ সহ রেজিস্টেন্স মুভমেন্টের অনেকেই। সেদিন রাতেই (২১ জুলাই প্রথম প্রহরে) স্টাউফেনবার্গ এবং তার সহযোগীদের ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে হত্যা করা হয়। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে স্টাউফেনবার্গ জীবন দেন মানুষের জন্য ভালোবাসায়। মৃত্যুর আগমুহূর্তে তিনি চিৎকার করে ওঠেন, "আমাদের পবিত্র জার্মানি দীর্ঘজীবি হোক"!
হিটলার মারা যায় এর প্রায় নয় মাস পরে। নিজের অপমানের বোঝা নিয়ে আত্মহত্যা করে সে। একদিক থেকে সে অবশ্য অমর হয়ে যায়। সে বেঁচে থাকে হারানোর তীব্র বেদনা নিয়ে টিকে থাকা মানুষের ঘৃণায়।
***
পুনশ্চ: ২০শে জুলাই প্লট নিয়ে একটি লেখা লেখার ইচ্ছে ছিল গতকাল। ২০ শে জুলাই। ইতিহাস বিষয়ক কোনো লেখা নয়। কেবল স্টাউফেনবার্গকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য লেখা। কিন্তু ১২ ঘন্টার টানা ল্যাবের ক্লান্তি ডিঙিয়ে আর লেখা হয়ে ওঠেনি।
রেজিস্টেন্সের অনেকেই প্রথমদিকে হিটলারের সমর্থক ও অনুসারী হওয়ায় এঁদের অনেককে নিয়েই বিতর্ক আছে। অনেকেই মনুষত্বের তীব্র বোধ থেকে নয়, কেবল ক্ষমতা আর রাজনীতির নোংরা ভাবনা থেকেই হিটলারকে হত্যা করতে চেষ্টা করেছেন। সেই আলোচনায় না যাই।
কেবল শ্রদ্ধা জানিয়ে যাই কর্ণেল স্টাউফেনবার্গকে। যিনি অন্তত চেষ্টা করেছিলেন মনুষত্ব বাঁচিয়ে রাখার। তাঁদের মতো কিছু মানুষের জন্যই আমরা আজও হাসতে পারি। হাসতে পারি তীব্র ঘৃণার বিষ হৃদয়ে ধরেও। হাসতে পারি শ্রদ্ধায় নত হয়ে।
আর যদিও জানি মানুষের ঘৃণায় হিটলার অথবা তার মতো প্রাণিদের কিছু এসে যায় না। তারপরও মানুষ বলেই, মৃত্যুর যন্ত্রণাকে ভুলে যেতে পারিনা বলেই আমরা তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করে যাই আমৃত্যু।
[এই ঘটনাটির উপরে নির্মিত অনেকগুলো চলচ্চিত্র আছে। সর্বশেষ মুক্তি পাওয়া ২০০৮ এর ভালকায়েরি ঘটনাটি সম্পর্কে বেশ একটা ধারনা দেবে। দেখতে পারেন ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের প্রামাণ্যচিত্র 42 ways to kill Hitler. বোমা হামলাটি ব্যর্থ হওয়ার কারণটির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা জানতে দেখতে পারেন Myth Buster (season 8 Episode 29). আরো দেখতে অথবা পড়তে চাইলে নেটে ক্লিক করলেই হবে। বিরাট লাইব্রেরি পেয়ে যাবেন হাতের নাগালে।]

Related Keywords

Germany ,United Kingdom ,Poland ,Berlin ,British ,German ,Aprila Africa ,Movement Many ,Magnum Library ,View Can National Geographic ,Her Name Hitler ,Fori Bihar ,Miracle Power ,Her Miracle ,Desert Fox ,April United Kingdom ,July Plot ,May It War ,Land Mine ,Hitler Special ,Start August ,Available Hitler ,Germany May ,Text ,March July ,Items For Text ,Whatever Colonel ,Hitler Or Her ,View Can ,ஜெர்மனி ,ஒன்றுபட்டது கிஂக்டம் ,போல்யாஂட் ,பெர்லின் ,பிரிட்டிஷ் ,ஜெர்மன் ,அதிசயம் பவர் ,பாலைவனம் நரி ,ஏப்ரல் ஒன்றுபட்டது கிஂக்டம் ,ஜூலை ப்லாட் ,நில என்னுடையது ,தொடங்கு ஆகஸ்ட் ,ஜெர்மனி இருக்கலாம் ,உரை ,அணிவகுப்பு ஜூலை ,

© 2024 Vimarsana

vimarsana.com © 2020. All Rights Reserved.