করোনাকে ভয় নয়, জয় করতে হবে করোনাকে ভয় নয়, জয় করতে হবে সালাহ্উদ্দিন নাগরী ২৮ জুন ২০২১, ০০:০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ কারোনাভাইরাস মহামারির প্রকোপ কমিয়ে আনার সবচেয়ে কার্যকর উপায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। ছবি: সংগৃহীত করোনা সংক্রমণ দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। গত দেড় বছরে পৃথিবীর সবকিছু ওলটপালট করে দিয়েছে এ ভাইরাস। বিশ্বজুড়ে ১৮ কোটিরও বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। মৃত্যুবরণ করেছেন প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। প্রতিদিন মৃত ও আক্রান্তের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এভারেস্ট চূড়া থেকে শুরু করে সমুদ্রের গভীরতম তলদেশ- সবখানেই করোনা তার থাবা বিস্তার করেছে। দুগ্ধপোষ্য শিশু, তরতাজা যুবক, অশীতিপর বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ- কেউ কোথাও নিরাপদ নয়। দেশে দেশে, অঞ্চলে অঞ্চলে করোনা তার রূপ বদল করে করে আরও ভয়ংকর হয়ে উঠছে। মাঝখানে (ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি) মানুষ একটু একটু করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করছিল; কিন্তু এর দ্বিতীয় ঢেউ আবার সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। মে মাসের মাঝামাঝির পর থেকে সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী, স্বাভাবিক জীবনযাত্রা আবারও স্থবির। ভারতে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের তাণ্ডব এখনো চলছে এবং ৭৪টিরও বেশি দেশে এটি ছড়িয়ে পড়েছে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে এর বিস্তৃতি সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। ওইসব জেলা থেকে আক্রান্তরা ভালো চিকিৎসা ও সুযোগ-সুবিধার আশায় ঢাকায় এসেছেন। এতে ঢাকাতেও এ ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ছে। আইসিডিডিআরবির গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যমতে, রাজধানীতে শনাক্ত হওয়া করোনা রোগীদের ৬৮ শতাংশই ভারতীয় ধরনে আক্রান্ত। আইইডিসিআরের গাইডলাইন অনুযায়ী, আক্রান্তের হার ১০ শতাংশের উপরে হলে সেই জেলাকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে উচ্চঝুঁকিপূর্ণ জেলার সংখ্যা ৫০। দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের তাণ্ডবের মধ্যেই জনস্বাস্থ্যবিদরা তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা করছেন। তারা কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি পালন এবং সম্মিলিতভাবে করোনা মোকাবিলায় গুরুত্ব দিচ্ছেন। এর ভয়াবহতা থেকে জনগণকে রক্ষায় ২৮ জুন থেকে কঠোর লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। প্রত্যেককে তা অনুসরণ করতে হবে নিজ স্বার্থেই। গত বছর করোনার শুরুর দিকে মানুষের মধ্যে করোনাজনিত যে ভয়-ভীতির উদ্ভব ঘটেছিল, মাঝখানে তা একটু একটু করে কমে এলেও এখন আবার এটি নানা চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথমত, কারও নিজের বা তার পরিবারের কারও যদি করোনা হয়, তাহলে আইসোলেশনের ব্যবস্থা তাদের ছোট্ট বাসায় কি সম্ভব হবে? যদি আইসিইউয়ের প্রয়োজন হয় সে কি তা পাবে? বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউয়ের প্রতিদিনের খরচ লাখ টাকার উপরে। কোথা থেকে আসবে এত টাকা? সে বা তার নিকটজন কি আইসিইউয়ের অভাবে মারা যাবে? চিকিৎসাবঞ্চিত থেকেই দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে? মৃত্যুবরণ করলে মৃতদেহের কাছে নিকটজনরা যাবে, নাকি শুধু সরকারি ব্যবস্থাপনায় দাফন কার্যক্রম সম্পন্ন হবে? এ ধরনের চিন্তা মানুষকে কুরে কুরে খাচ্ছে। বয়স্কদের নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হয়, চেকআপে থাকতে হয়। কিন্তু এ সময় ডাক্তার দেখানোটাই তো জটিল। হাসপাতালগুলো কোভিড রোগীতে ভর্তি, অন্য রোগীরা সেখানে যেতেই ভয় পাচ্ছেন। অধিকাংশ ডাক্তারই প্রাইভেট প্র্যাকটিস করছেন না। কেউ কেউ অনলাইনে রোগী দেখলেও অনেক ক্ষেত্রে ডাক্তার-রোগী কারও কাছেই বিষয়টি খুব একটা সুখকর নয়। যারা দেশের বাইরে চিকিৎসা নেন, তারা বাইরে যেতে পারছেন না। ফলে চিকিৎসাহীনতার এ পরিস্থিতি মানুষকে ভীতি ও শঙ্কার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। যারা করোনা জয় করে ফিরে আসছেন, তারাও যে খুব নিশ্চিন্তে আছেন তা নয়। নতুন করে ডায়বেটিস, হাইপারটেনশনে ভুগছেন, দুর্বলতা, শরীরে ব্যথা এবং পুরোনো রোগ নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে উঠছে। করোনা জয়ী প্রিয়জনদের কোভিড-পরবর্তী জটিলতায় মৃত্যু তাদের আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে। মানুষ আবারও ঘরবন্দি হয়ে পড়ছে এখন। যারা নিয়মিত হাঁটতেন তাদের হাঁটা বন্ধ, শরীরে অসুখ না থাকলেও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে সামান্য জ্বর, সর্দি-কাশিতেই আতঙ্কিত হচ্ছে, মনে করছে এই বুঝি করোনা তাকে ধরে ফেলল। ভয়ে অধিকাংশ মানুষ তটস্থ থাকছে। ঘরবন্দি মানুষের বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে। রাতে বিছানায় ছটফট করছে, ঘুমের বড়ি খেয়েও ঘুম হচ্ছে না। প্রিয়জনের অসুস্থতা, করোনায় আক্রান্তের যন্ত্রণা, চারদিকে মৃত্যুর মিছিল- এসব দেখতে দেখতে মানুষ অস্থির। এ পরিস্থিতি মানুষের স্বাভাবিক চিন্তা-চেতনা, কর্মস্পৃহাকে নিঃশেষ এবং সৃজনশীলতাকে চুরমার করে দিচ্ছে। করোনা নিয়ে এই যে এত ভয়, এত অস্থিরতা, এত চিন্তা, তারপরও কি মানুষ করোনা মোকাবিলায় আন্তরিক? আমাদের কাজেকর্মে কি সতর্কতার বিষয়টি প্রকাশ পাচ্ছে? আমরা কি আইন মান্যতাকে ধর্তব্যে আনছি? নাকি সবকিছু সরকারের ওপর ছেড়ে দিয়ে নিজেকে নির্ভার রাখছি? মনে রাখতে হবে, সরকারি সিদ্ধান্তগুলো মেনে চলার সহজ অর্থ হলো নিজেকে সুরক্ষিত ও নিরাপদ রাখা। এ রোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার এবং মহামারির প্রকোপ কমিয়ে আনার সবচেয়ে কার্যকর উপায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। লকডাউন চললেও প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যেতে হচ্ছে। আমাদের অনেকেই স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্বকে মোটেই গুরুত্ব দিতে চাচ্ছে না। ঘর থেকে বের হলে রাস্তাঘাট, মার্কেট, উদ্যানে যত মানুষ দেখা যায়, তাদের অধিকাংশের মুখেই মাস্ক থাকে না। ‘মাস্ক’ না পরে, সামাজিক দূরত্ব না মেনে জনারণ্যে ঘোরাফেরা করলে করোনা থেকে যে রেহাই পাওয়া যাবে না, এ কথাটি আমরা ভুলে যাই কেন? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, শহরকেন্দ্রিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অনলাইন ক্লাস, পরীক্ষা, প্রাইভেট কোচিং, গ্রুপ কোচিং সবই হচ্ছে। কোনো শিক্ষক রাত ১০/১১টায়, কেউ আবার ভোর ৭টায় ক্লাস নিচ্ছেন। অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে স্মার্টফোনের মাধ্যমেই অনলাইনে যুক্ত হতে হচ্ছে। তিন, চার ঘণ্টা এক দৃষ্টিতে ছোট্ট একটি ডিভাইসের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শারীরিক ও মানসিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে। অনেকেই সারা রাত জেগে থাকছে, সারা দিন ঘুমাচ্ছে। দৈনিক রুটিনই পরিবর্তন হয়ে গেছে। মাথাব্যথা ও অস্বস্তি নিয়ে ঘুম থেকে উঠছে। অনেক শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়ছে, বিষণ্নতায় ভুগছে। এ বিষয়গুলোকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সমাধান করতে হবে। নতুবা তাদের মনে বিষণ্নতা থেকে ভয়ভীতির উদ্ভব হতে পারে। করোনায় ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায়। এতে ক্লান্তি বাড়ে, যা দূর হতে অনেক সময় লেগে যাচ্ছে। তাই কোভিড-পরবর্তী সময়ে নিজেকে সুস্থ রাখতে এবং আগের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার জন্য ১৫ দিন থেকে ক্ষেত্রবিশেষে এক মাসের পূর্ণ বিশ্রাম দরকার। এ সময় ভাজা-পোড়া, অতিরিক্ত মিষ্টি, তৈলাক্ত খাবার এবং ফাস্টফুড, জাংকফুড পুরোপুরি পরিহার করতে হবে। ঘরের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করতে হবে, শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সচল রাখতে পরিমিত ব্যায়ামের কোনো বিকল্প নেই। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গল্প করা, সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটানো, তাদের ভালো উপদেশ দেওয়া, তাদের লেখাপড়ায় এবং স্ত্রীকে ঘরের কাজে সহযোগিতা প্রদান, সর্বোপরি ঘরের পরিবেশকে সুখকর রাখা প্রয়োজন। এখন যেহেতু বাইরে যাওয়া হচ্ছে না, তাই টিভি খুলে সারাক্ষণ করোনার খবর দেখার দরকার নেই। বিশেষত দুর্বল চিত্তের ব্যক্তিদের এতে ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, তাদের মনের মধ্যে অসহায়ত্ব জেঁকে বসতে পারে। সতর্ক থাকতে হবে অবশ্যই, কিন্তু তাই বলে সবসময় করোনার চিন্তা করা যাবে না। চীনের উহান প্রদেশে যখন প্রথম করোনার প্রাদুর্ভাব হয়, তখন করোনা মোকাবিলার পদ্ধতি এবং এখনকার পদ্ধতিতে ব্যাপক পার্থক্য তৈরি হয়েছে। ওই সময় টিভিতে দেখেছি, স্পষ্ট মনে আছে, তখন বাসাবাড়ির দরজা-জানালা সবকিছুই বন্ধ রাখা হতো, যেন করোনাভাইরাস ঘরে ঢুকতে না পারে। মানুষ যত গবেষণা করেছে, আমাদের করোনা মোকাবিলার পদ্ধতিও তত পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। আমরা জানি- অফিস, দোকান, রেস্তোরাঁ, যানবাহন ও হাসপাতাল থেকেই ৯০ শতাংশের বেশি সংক্রমণ হয়ে থাকে। বদ্ধ পরিবেশে বায়ু চলাচল বাইরের তুলনায় কম থাকায় করোনা আক্রান্ত কারও নিঃশ্বাসের সঙ্গে নিঃসৃত ভাইরাস ঘরের মধ্যে বা বদ্ধ পরিবেশে অবস্থানরত অন্যদেরও আক্রান্ত করে। এমনকি ওই বদ্ধ পরিবেশে বেশ কিছুক্ষণ পরও কেউ প্রবেশ করলে তারও আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। ভিন্ন ভিন্ন বাসাবাড়িতে অবস্থান করা ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সশরীরে যদি কোনো ধরনের মিটিং, আলোচনা করতেই হয়, তবে ঘরের বারান্দা, ছাদ, খোলা জায়গাকে বেছে নেওয়া ভালো। বাসাবাড়ি, দোকানপাট, অফিসে এয়ারকুলারের বদলে পাখা ব্যবহার করতে হবে। এসি চালানোর যদি দরকার হয়ই, তাহলে অন্তত একটি দরজা বা জানালা খোলা রেখে বায়ু চলাচলের জন্য সামান্য হলেও ব্যবস্থা রাখতে হবে। এতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমবে। উন্নত দেশগুলোতে করোনা নিয়ে নিয়মিত গবেষণা হচ্ছে। নিত্যনতুন পর্যবেক্ষণ পুরোনো সিদ্ধান্তকে পাল্টে দিচ্ছে। আমাদের গবেষণা সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো এ সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ, বিশেষত ব্যক্তি পর্যায়ে করণীয়গুলো সবাইকে দ্রুত জানানোর উদ্যোগ নিলে করোনা মোকাবিলা যেমন সহজ হবে, একইসঙ্গে মানুষের ভয়ভীতিও দূর হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইউরোপ অঞ্চলের পরিচালক কয়েকদিন আগে বলেছেন, অন্তত ৭০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনার আগ পর্যন্ত চলমান করোনা মহামারি শেষ হবে না। তবে ইউরোপের দেশগুলোতে টিকা দেওয়ার গতি খুব ধীর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকা নেওয়া থাকলে