অর্থনীতি ও নৈতিকতা শতফুল ফুটতে দাও অর্থনীতি ও নৈতিকতা ড. মাহবুব উল্লাহ্ ১৫ জুলাই ২০২১, ০০:০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ দার্শনিক ইম্যানুয়েল কান্ট লিখেছেন, ‘In the kingdom of ends, everything as either a price, or a dignity. What has a price can be replaced with something else, as its equivalent; whereas what is elevated above any price, and hence allows of no equivalent, has a dignity.’ আরেকজন দার্শনিক মাইকেল স্যান্ডেল লিখেছেন, 'If you pay a child a dollar to read a book, as some schools have tried, you not only create an expectation that reading makes a money, you also run the risk of depriving the child forever of the value of it. Markets are not innocent.’ মুক্ত উদ্যোগ এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির গুণাবলি সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী মানুষের ভিন্নতর ধারণা বিদ্যমান। ২০০৫ সালে একটি জরিপ করা হয়েছিল, তা থেকে জানা যায় পৃথিবীর ৬১ শতাংশ মানুষ বিশ্বাস করে বাজার অর্থনীতি ভবিষ্যতের জন্য একটি উত্তম ব্যবস্থা। জার্মানির ৬৫ শতাংশ মানুষ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৭১ শতাংশ মানুষ এবং চীনের ৭৪ শতাংশ মানুষ বাজার সম্পর্কে একই ধরনের কথা বলেছে। অর্থাৎ বাজার ভবিষ্যতের জন্য একটি ভালো ভিত্তি তৈরি করে। কিন্তু ৪৩ শতাংশ রুশ, ৪২ শতাংশ আর্জেন্টাইন এবং ৩৬ শতাংশ ফরাসি বাজারের ওপর আস্থা রাখে। মানুষের এ ধরনের বিশ্বাস একটি দেশকে অর্থনৈতিক বিষয়ে পছন্দ নির্ধারণে প্রভাবিত করে। বাজারে যদি যথেষ্ট প্রতিযোগিতা থাকে, তাহলে ফার্মগুলো তাদের পণ্যের দাম কমাতে বাধ্য হয় এবং গৃহস্থালির ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। প্রতিযোগিতা উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করার প্রণোদনা সৃষ্টি করে। উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করা সম্ভব হয় উদ্ভাবনা এবং বাণিজ্য বৃদ্ধির মাধ্যমে। বাজার অর্থনীতির আরেকটি উপকারিতা হলো এটি সাধারণ মানুষকে তদবির ও স্বজনপ্রীতির নেতিবাচক প্রভাব থেকে রক্ষা করে। কেন্দ্রায়িত অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সম্পদ বরাদ্দে তদবির ও স্বজনপ্রীতি যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। এসব কারণেই ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর বিশেষ সুবিধা রহিত করা হয়। একইভাবে ফ্রান্সে ১৭৯১ সালে ‘গিল্ড’ প্রথাও উচ্ছেদ করা হয়। একই কারণে বিংশ শতাব্দীর শেষপাদে কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ধসে পড়ে। এসব কারণে অর্থনৈতিক জীবনে প্রতিযোগিতামূলক বাজার কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। স্বেচ্ছাতন্ত্রের অর্থনীতি থেকে বেশ কিছু জিনিস ছেঁটে ফেলতে হয়, যাতে বাজার অর্থনীতির উপযোগিতা ভোগ করা সম্ভব হয়। অর্থনীতিবিদরা বাজার ব্যর্থতা নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন এবং দেখাতে চেষ্টা করেছেন কীভাবে জননীতির মাধ্যমে এগুলো পরিশুদ্ধ করা যায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ প্রতিযোগিতা আইন, খাতভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ, পরিবেশগত বাহ্য প্রভাবের ওপর কর আরোপ, ট্রাফিক জ্যাম হ্রাস করার জন্য ফি আরোপ করা, মুদ্রানীতি এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা অর্জন ইত্যাদি উল্লেখ করা যায়। এ ছাড়াও সরকার যাতে মূল্যবান বস্তু বা সেবা তৈরি হতে পারে তার জন্যও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। দৃষ্টান্তস্বরূপ শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং সম্পদের পুনর্বণ্টন। অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ বাজার ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা স্বীকার করেও এ ব্যবস্থাকে সমর্থন করে, যার কারণ ইতোমধ্যেই বলা হয়েছে। বাজার একটি হাতিয়ার মাত্র। এটি নিজেই কোনো লক্ষ্য নয়। দার্শনিক, মনোবিজ্ঞানী, সমাজতত্ত্ববিদ, আইনজ্ঞ, রাজনীতি বিজ্ঞানী, নাগরিক সমাজের বড় অংশ এবং বেশিরভাগ ধর্মে বাজার সম্পর্কে ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এরা বাজারের গুণাবলির স্বীকৃতি দেন, কিন্তু তারা অর্থনীতিবিদদের সম্পর্কে নৈতিক বিষয়গুলোকে যথেষ্ট পরিমাণে গুরুত্ব না দেওয়ার জন্য অভিযোগ করেন। তাদের অভিযোগ হলো বাণিজ্য ও বাণিজ্যবহির্ভূত বিষয়গুলোর মধ্যে সীমারেখা টানতে না পারা। দৃষ্টিভঙ্গির এ পার্থক্য হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক মাইকেল স্যান্ডেল রচিত এবং বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত গ্রন্থ ‘What Money Can't Buy: The Moral Limits of Markets’-এ আলোচনা করা হয়েছে। স্যান্ডেল যুক্তি দিচ্ছেন, অনেক ধরনের পণ্য ও সেবা রয়েছে যেমন-শিশু পালক নেওয়া, নিজের নয় এমন সন্তানের অভিভাবকত্ব গ্রহণ, যৌনতা, মাদক, সামরিক চাকরি, ভোটাধিকার, দূষণ এবং দেহের অঙ্গ প্রতিস্থাপনসহ অনেক কিছু আছে, যা বাজারভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গিতে গুরুত্ব পায় না। এ ছাড়াও বলা যায়-বন্ধুত্ব কেনা যায় না, বিশ্বের নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কেউ ভর্তি হতে পারে না, অথবা নোবেল প্রাইজও কেনা যায় না। জিন ও জীবন্ত টিস্যু পেটেন্টযোগ্য হওয়া উচিত নয়।