টিভি নাটকে এসে তিনি একটা ট্রেন্ড সেট করে দিয়েছিলেন, সিনেমায়ও। সেই মোস্তফা সরয়ার ফারুকী প্রথমবার আসছেন ওটিটি প্ল্যাটফর্মে। আগামীকাল জি-ফাইভে মুক্তি পাবে তাঁর ৮ পর্বের সিরিজ ‘লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলমেন’। এ উপলক্ষে দীর্ঘ এক কথোপকথনে জড়িয়েছেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। ফোনের এপারে ছিলেন দাউদ হোসাইন রনি- আপনার কলটি রেকর্ড করা হচ্ছে [মুঠোফোনের স্বয়ংক্রিয় কণ্ঠ] ওমা! এটা আবার কোন সিস্টেম! সার্ভেইল্যান্সের যুগ। নিরাপত্তার স্বার্থে ফোন কম্পানিগুলো তাদের ব্যবহারকারীদের সতর্ক করে দিচ্ছে। আপনার সিরিজের ট্রেলারে যেমন শুনতে পাই, ‘আমি কিন্তু তোমাগো মাথার ওপর সিসি ক্যামেরা হইয়া বইসা রইছি...’ ...তোমরা কখন কী করো সব দেখি, সব জানি। হা হা হা। এখান থেকেই প্রশ্ন করি। এই যুগে আমরা সবাই কিন্তু কঠোর নজরদারিতে রয়েছি, যখন-তখন অডিও ক্লিপ ফাঁস হয়ে যেতে পারে। এই যে ‘সিসি ক্যামেরা’র সংলাপ, এটা দিয়ে আপনি কাকে বোঝাচ্ছেন? সরকারযন্ত্র, নাকি অন্তর্যামী ঈশ্বর? [অট্টহাসি]...যে চরিত্রের মুখে সংলাপটা, সে চরিত্রটাকেই বুঝিয়েছি। চরিত্রটার মাধ্যমে এ সময়টাকে বোঝা যেতে পারে। কেবল বাংলাদেশ না, সারা পৃথিবীতেই সার্ভেইল্যান্স চলছে। [একটু থেমে] শোশানা জুবফ একটা বই লিখেছেন—‘দ্য এজ অব সার্ভেইল্যান্স ক্যাপিটালিজম’। এ বিষয়ে ইউটিউবে তাঁর বেশ কিছু লেকচারও আছে। তবে আমার গল্পের চরিত্রের সংলাপটা স্পেসিফিক দৃশ্যের জন্যই। দক্ষিণ এশিয়ায় ওয়েব সিরিজ মানেই যেন থ্রিলার। ‘লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলমেন’-এর ট্রেলার দেখে মনে হয়েছে, এটা একটু আলাদা। বাংলাদেশের গল্প, কিন্তু প্রেজেন্টেশন ইউরোপীয় তরিকায়... ইউরোপীয়রা মনে করে আমি বাংলাদেশের, বাংলাদেশিরা মনে করে আমি ইউরোপের। আমার ক্ষেত্রে যে সমস্যাটা হয়, চাইলেও আমি অন্যদের মতো কাজ করতে পারি না। এমনকি নিজের মতোও করতে পারি না। ধরা যাক, ‘ব্যাচেলর’ খুব পছন্দ করেছে কিছু মানুষ, পরে হাজার চাইলেও আরেকটা ‘ব্যাচেলর’ বানাতে পারিনি। আর অন্যদের মতো কাজ করতে পারাটা তো আরো মুশকিল। জাতীয় সংগীতও আমি একই সুরে দ্বিতীয়বার গাইতে পারি না। আরেকটা কথা আমি সব সময় বলি, ছবির চরিত্র আমার ভিজ্যুয়াল স্টাইল নির্ধারণ করে দেয়। ‘টেলিভিশন’ ছবির চরিত্রগুলো যতটা কালারফুল, যতটা ইমোশনাল, সেটার ইম্প্যাক্ট কিন্তু ভিজ্যুয়ালিও পড়েছে। চরিত্রই ছবির ন্যারেটিভ স্টাইল ঠিক করে দিয়েছে। আবার ‘ডুব’ ইজ সো কোয়াইট, সো সাইলেন্ট। কারণ চরিত্রগুলো খুবই ইন্ট্রোভার্ট। ‘লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলমেন’-এ আমি নতুন একটা চরিত্র নিয়ে ডিল করেছি। গল্প নতুন, সংকটও নতুন। সে কারণে এটার ভিজ্যুয়াল স্টাইলও নতুন। আমরা কি ‘লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলমেন’কে কোনো জনরায় ফেলতে পারব? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে সব সময়ই আমি ব্যর্থ হই। ‘টেলিভিশন’-এর সময় বুসানের সমাপনী সংবাদ সম্মেলনে হলিউড রিপোর্টারের সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিল, ‘ছবিটা আমরা দেখেছি, পছন্দও করেছি। কিন্তু ছবিটাকে কোনো এক জনরায় ফেলতে খুব কষ্ট হচ্ছে। তোমার মতে এটা কোন জনরার ছবি?’ উত্তরে বললাম, আমি আসলেই জানি না। আমার প্রতিটি কাজই মিক্সড জনরার মধ্যে পড়ে। তবে আপনি যে ছবিই বানান না কেন, সংলাপ বা দৃশ্যে কিছু শীতল হিউমার বা স্যাটায়ার থেকেই যায়... হুম্। কিন্তু ‘ডুব’-এ নাই। কম, তবে আছে। পর্দার চরিত্রগুলো হয়তো একেবারে দুঃখকষ্টে জর্জরিত, কিন্তু তারা এমন কিছু অ্যাক্টিভিটি করে বসে, যেটা খুবই হিউমারাস। আমি সব সময়ই বলি, যেকোনো শিল্পীর কাজে বা কবির কবিতায় তাঁর ব্যক্তিত্ব অনূদিত হয়। শামসুর রাহমানের কবিতা তাঁর ব্যক্তিত্বের মতো, আল মাহমুদের কবিতা তাঁর মতো। আমার ছবিও আমার ব্যক্তিত্বের অনুবাদ। আমার ব্যক্তিত্বের মধ্যে অবশ্যই স্যাটায়ার, ইমোশনের নানা দিক আছে। লক্ষ করলে দেখবেন, ‘টেলিভিশন’ শুরু হয়েছে একটা স্যাটায়ার ফিল্ম হিসেবে, শেষ হয়েছে একটা ইমোশনাল ছবি হিসেবে। থ্রিলার আর সেক্স কমেডিতে ডুবে থাকা অঞ্চলের দর্শকদের জন্য হঠাৎ ‘খিচুড়ি’ জনরা নিয়ে হাজির হয়েছেন আপনি। ওটিটির নিয়মিত দর্শকদের টানতে পারবেন তো? আমি মনে করি, একই মানুষ বিভিন্ন রকমের খাদ্য গ্রহণ করতে পারে। কখনো বিরিয়ানি, কখনো শুধু কাঁচা মরিচ দিয়ে ভাত খেতে পারে, আবার তেহারিও খেতে পারে। দর্শক টানার জন্য নির্দিষ্ট ঘরানার ফিল্মই বানাতে হবে—এটা আমি বিশ্বাস করি না। নারী-পুরুষের সম্পর্ক, অধিকার, ইগো নিয়ে আমরা ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ দেখেছি। ‘লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলমেন’-এ কি আপনি এ বিষয়গুলো নতুন কোনো অ্যাঙ্গলে দেখাতে চাইছেন? আমার ছবিতে স্ট্রং নারী চরিত্র বরাবরই থাকে। নারীবাদ বা শক্ত নারী চরিত্র নিয়ে ছবি করা এখন ফ্যাশন। এই ফ্যাশন চালু হওয়ার আগেই আমার ছবিতে দৃঢ়চেতা নারী চরিত্র এসেছে। ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’-এ তো প্রবলভাবেই ছিল। কেন আমার ছবির নারী চরিত্রগুলো দৃঢ়চেতা হয়? এর পেছনে কারণ আছে। আমার জীবনে তিনজন নারীর প্রভাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ—আমার মা, বড় বোন ও আমার স্ত্রী। আমার মায়ের মতো দৃঢ়চেতা নারী কোথাও দেখিনি। নানা তাঁকে স্কুলে পাঠাননি, তিনি মামাদের বই পড়ে পড়ে পড়ালেখা শিখে নিয়েছেন। আমার বাবা প্রায়ই ব্যবসায় ধরা খেতেন। একবার খুবই বাজেভাবে ধরা খেলেন। পরিবারের সবাই মিলে তখন এক রুমের বাসায় উঠেছি, দিনে এক বেলা ভাত খেতে শুরু করলাম আমরা। আমার মা কোনো দিন নাখালপাড়ার রাস্তা চিনতেন না, উনি যতবারই বাড়ির বাইরে যেতেন একটা গাড়িতে উঠতেন, গাড়ির জানালা তখন পর্দায় ঢেকে দেওয়া হতো, যেন উনাকে কেউ না দেখে। সেই মা কোথা থেকে যেন এনজিওর লোন নিয়ে এলেন। ১৯৮৭-৮৮ সালে যখন চারপাশের কেউ এনজিওর নামও শোনেনি, তখনকার কথা। লোনের টাকা দিয়ে বাসার ছাদে মুরগির খামার করলেন, সেই টাকা দিয়ে আমাদের পড়ালেখা করালেন। আমার মা ভীষণ প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কোনো দিন হার মানেননি। মা যখন মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে শুরু করেন তখন ঢাকা শহরে নারীদের মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়া নিষিদ্ধ ছিল। মহাখালীর গাউসুল আজম মসজিদে একদিন তিনি নামাজ পড়তে গেছেন, কিন্তু সেখানে নারীদের নামাজ পড়ার কোনো ব্যবস্থা নাই। তিনি আর্গুমেন্ট করে সেখানে নামাজ পড়েছেন। পরে অন্য নারীদের নিয়ে গিয়ে সেখানে নামাজ পড়তেন। এখন তো গাউসুল আজম মসজিদে শত শত নারী নামাজ পড়তে যায়। আমার বড় বোন ক্লাস সেভেন-এইটে স্কুল থেকে ফিরে ছোট ভাই-বোনদের কোলে নিয়ে রান্নাবান্না করতে বসে যেতেন, কারণ মা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। আমার স্ত্রী, ক্লাস নাইনে পড়ার সময় বাবাকে হারিয়েছে। একা নিজের ক্যারিয়ার গড়েছে, পরিবার চালিয়েছে। এ রকম অনেক স্ট্রং নারী চরিত্র আমি দেখেছি। আমি দেখেছি, আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ দৃঢ়চেতা নারীদের কী পরিমাণ ভয় পায়। তো, এই নারীরা আমার ছবিতে এসেছে বিভিন্নভাবে। প্রশ্ন উঠতে পারে, ‘লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলমেন’-এর মেয়েটা কি ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’-এর মেয়েটা? একদমই না। তার সমস্যা আলাদা, তার চ্যালেঞ্জ আলাদা। আরেকটা কথা, নারী ইস্যু নিয়ে ছবি বানালে অনেকে ভাবেন, এটা কি এনজিওর ছবি নাকি! ‘লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলমেন’ সিরিজকে নারীবাদী ব্র্যাকেটে ফেলার উপায়ও নেই। এখানে কোনো সাদাকালো চরিত্র নাই, অনেক গ্রে এরিয়া আছে। যে কারণে আমরা এটাকে নারীবাদী ছবি বলছি না কোথাও। যতটা জেনেছি তাতে মনে হয়েছে, ব্যক্তিজীবনে আপনি হয়তো সুফিজমের চর্চা করেন... অফ কোর্স। নারীবাদ প্রসঙ্গ যখন এলোই, এ প্রসঙ্গে আরেকটা সম্পূরক প্রশ্ন করতে চাই। অনেকের ধারণা, কেবল নারীরাই নারীবাদী হন। আসলে কিন্তু পুরুষরাও নারীবাদী হতে পারেন। এ ক্ষেত্রে আপনার মত কী? বা নারীবাদী হওয়াটা কি দূষণীয়? অবশ্যই পুরুষরা নারীবাদী হতে পারেন। আমি মনুষ্যবাদী হলেই নারীবাদসহ সকল বাদই এর মধ্যে চলে আসে। আমি সহজ-সরল জিনিসে বিশ্বাস করি, পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীর লিঙ্গ, বয়স, ধর্ম নির্বিশেষে তার ডিগনিটি রক্ষা করে স্বাধীনভাবে বাঁচবার অধিকার আছে। আবার এটাও জানি, এ পৃথিবীর সিস্টেম সেটা হতে দেয় না। হতে না দিলেই তখন লড়াই-সংগ্রামের প্রশ্ন আসে। এই অধিকারের জায়গায় নারীবাদও আছে, এনিম্যাল রাইটস, মাইনরিটি রাইটসও আছে। বাংলাদেশে যেমন হিন্দু রাইটস, আবার ভারতে মুসলিম রাইটস। আলোচনা ভারী হয়ে উঠছে। আমরা এখান থেকে বের হই। টিভি ফিকশন নির্মাণে এসে আপনি একটা ট্রেন্ড সেট করেছিলেন, ফিল্মে আসার পরও তা-ই হলো। এবার আপনি আসছেন ওয়েবে। ওয়েবে নামার আগে কি সচেতনভাবেই ভেবেছিলেন, ‘আমাকে এমন একটা কিছু করতে হবে, যাতে মনে হবে, আই অ্যাম দ্য বস?’ নাহ্। আমার আশপাশে যারা থাকে তারা জানে, আমি সব সময় শিশুর মতো আনন্দে থাকি। আমি যখন কাজ করি তখন বাচ্চাদের মতো কাদামাটি ডানে টিপি বাঁয়ে টিপি। কখনো এটা ঘোড়া হয়, কখনো আবার হাতির দিকে চলে যায়। এই মুহূর্তে আমি কালার গ্রেডিং করতে করতেই কথা বলছি। শিশুর আনন্দে খেলছি, একেবার ডানে যাই আবার বাঁয়ে যাই, কাজটা নিয়েই অবসেসড থাকি। এটা কোনো ট্রেন্ড সেট করবে কি না বা কাল্ট হবে কি না, আমার মনে হয় না কোনো শিল্পীই এসব ভেবে কাজ করতে পারেন। তা ছাড়া নতুন ধারা এভাবে বলেকয়ে হয়ও না। করোনা মহামারি আসার পর ওটিটির উত্থান হলো, আগে থেকেই ছিল, এখন আরো প্রসারিত হয়েছে। পাশাপাশি এই মাধ্যমের একটা ব্যাকরণও তৈরি হয়েছে। সিরিজের প্রথম পর্বের শেষে একটা ক্লিপ হ্যাঙ্গার থাকবে, পরের পর্বে যেন দর্শকের আগ্রহটা থাকে। এ ক্ষেত্রে আপনি কী করেছেন? অন্যদের দেখানো ব্যাকরণ মানছেন, নাকি নিজেই ব্যাকরণ তৈর