The greatest enemy of knowledge is not ignorance, it is the illusion of knowledge. – স্টিফেন হকিং এই একটি বাক্যের মধ্যেই এমন অনেক কিছু ফুটে উঠে যা এই বিশ্বায়ন এবং মিডিয়ার যুগে খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বায়নের কারণে প্রতিটি দেশ যেমন পরস্পরের সাথে জড়িয়ে পড়ছে, তেমনি মহাশক্তিগুলোর দৌর্দণ্ড প্রতাপে মাফিয়া বা গ্যাং সন্ত্রাসের বদলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের জন্ম হচ্ছে। এই সন্ত্রাস এত সুন্দর মুখোশ পরে থাকে যে আমরা তার নগ্ন সম্রাজ্যবাদী এবং ফ্যাসিবাদী রূপটা দেখতে পাই না। মুখোশের আড়ালে থেকে এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস অত্যাধুনিক যুগের অভিনব “টেররিজম” তৈরী করে এবং নিজের স্বার্থে সেই টেররিজমকেই লালন করে। এসব অপকর্মে তাদের প্রধান সহকারী হয় মিডিয়া। আধুনিক পুলিশী রাষ্ট্রের সবচেয়ে কার্যকরী হাতিয়ার হচ্ছে মিডিয়া। “অকুপেশন ১০১” (Occupation 101) প্রামান্য চিত্রটি শুরু হয়েছে স্টিফেন হকিং এর এই উক্তি দিয়ে। ডকুমেন্টারির বিষয় ইসরায়েলের অবৈধ আগ্রাসন এবং ফিলিস্তিন অধিকার। ডক্যুটা দেখার পর জীবনের অধিকাংশ কাজকেই একেবারে অর্থহীন মনে হচ্ছে। এখান থেকে রেচেল কোরি নামের এক মার্কিন ছাত্রীর কথা জানলাম যে ফিলিস্তিনে গিয়েছিল তাদের দুর্দশার ভাগীদার হতে, ইসরায়েলের আগ্রাসন মার্কিনীদের সামনে তুলে ধরতে। কিন্তু মাত্র ২৩ বছর বয়সে ইসরায়েলী সৈন্যদের হাতে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। সে কোন ওয়ার জোনে থাকতো না, সাধারণ ফিলিস্তিনী শরণার্থী শিবিরই ছিল তার আবাসস্থল। মৃত্যু ফ্রন্টিয়ার ছেড়ে ফিলিস্তিনের কত গভীরে প্রবেশ করেছে তা মার্কিনীরা এতে কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছে। রেচেল কোরি নিয়মিত মা-বাবাকে মেইল করে তার অভিজ্ঞতার কথা জানাতো। এমনই একটি মেইলের শেষ লাইন ছিল: I think it is a good idea for us all to drop everything and devote our lives to making this stop. অকুপেশন ১০১ দেখার পর ঠিক এ কাজটাই করতে ইচ্ছে করে যদিও একটু পরেই নিজের সীমাবদ্ধতাটা বুঝতে পারি। তৃতীয় বিশ্বের এক কোণায় বসে এই আমার পক্ষে কতটুকুই বা করা সম্ভব। হতাশা ছাপিয়ে তখন কেবল আন্তর্জালের কথাই মনে হয়। ইন্টারনেট ছাড়া আমার ভাব প্রকাশের বা দায়িত্ব পালনের আর কোন উপায় আপাতত আছে কি? না, কিছুই খুঁজে পাই না। তাই কেবল লিখেই যাই আর সান্ত্বনা হিসেবে এর পক্ষে কিছু যুক্তি খুঁজে বের করি- হয়ত এই লেখা পড়ে এমন কেউ উদ্বুদ্ধ হল যার কর্মক্ষমতা আমার চেয়ে বেশি। এভাবে একটা হায়ারার্কি তো কাজ করতে পারে, উঠতে উঠতে সেই সচেতনতা কি আমাদের রাষ্ট্রনেতাদেরও ছুঁয়ে দিতে পারে না! আমরা সবাই যদি বিশ্ব জুড়ে মানবতার দলন সম্পর্কে সচেতন হই তাহলে আমাদের নেতারাও কি কিছুটা সচেতন হতে বাধ্য হবে না। কিংবা এরই মাধ্যমে একদিন কি আমাদের মধ্য থেকে মানবতাবাদী কোন নেতার জন্ম হতে পারে না! হয়তো হবে কিছু, হয়তো হবে না… অকুপেশন ১০১ মূলত মার্কিন দর্শকদের জন্য বানানো। আমেরিকার সাধারণ মানুষকে মার্কিন মিডিয়ার অপপ্রচার সম্পর্কে সচেতন করে তোলাই এর মূল উদ্দেশ্য। প্রামান্য চিত্রের ধারাবর্ণনা করেছেন Alison Weir নামের এক মার্কিন সাংবাদিক যিনি বেশ কিছুকাল যাবৎ ফিলিস্তিনে কাজ করছেন। তিনি ফিলিস্তিনের প্রকৃত অবস্থা সবাইকে জানানোর জন্য “If Americans Knew” নামে একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। মার্কিন দর্শকদের লক্ষ্য করে ডক্যুমেন্টারি বানানোর কারণটিও সহজে বোঝা যায়: বর্তমানে ইসরায়েলের আগ্রাসন থামানোর প্রধান উপায় তার প্রতি মার্কিন সমর্থন তুলে নেয়া। একটা পরিসংখ্যান থেকে অবাক হয়েছি- ১৯৪৯ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে মোট ৬২.৫ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়েছে, আর ইসরায়েল ছাড়া বাকি পুরো বিশ্বকেও দিয়েছে ৬২.৫ বিলিয়ন ডলার। ১৯৪৯ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলকে মোট ১০৮ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়েছে, অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন দিয়েছে ৬ থেকে ৮ মিলিয়ন ডলার। জায়নিস্ট আন্দোলন সব যুগেই সবচেয়ে পরাক্রমশালী শক্তি থেকে পাওয়া সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছে। এই সুযোগ সন্ধানের ইতিহাস শুরু হয়েছে নেপোলিয়নের যুগ থেকে। সে সময় তুরস্কের উসমানী সম্রাজ্যের মৃত্যু ছিল আসন্ন। বিশ্বের পরাশক্তিগুলো হা করে তাকিয়ে ছিল মধ্যপ্রাচ্যের দিকে, মৃত উসমানী সম্রাজ্যের কোন অংশ কে নেবে- এই নিয়ে চলছিল প্রতিযোগিতা। সে সময়ই নেপোলিয়ন সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাটি করেন। কিন্তু ওয়াটারলুতে পরাজয়ের কারণে তার সব স্বপ্ন ভেস্তে যায় এবং মঞ্চের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে ব্রিটেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্বভাবতই এই নিয়ন্ত্রণ চলে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। তবে বিস্তারিত ইতিহাসে না গিয়ে আমি সরাসরি ফিলিস্তিনে ইহুদী উপনিবেশ স্থাপনের সূচনালগ্নে চলে যাচ্ছি। কারণ পরিকল্পনার সরাসরি বাস্তবায়ন এখান থেকেই শুরু হেয়েছে। এরকম একপাক্ষিক সেটেলমেন্টের ধারণা অনেকের কাছেই অবাস্তব মনে হতে পারে। নেপোলিয়ন থেকে শুরু করে পুরো ইতিহাস বুঝলে সেটা মনে হওয়ার কোন কারণ নেই। কারণ রাজনীতির গাণিতিক চালেই সবকিছু হয়েছে। ফিলিস্তিন সমস্যা নিয়ে আমার প্রথম লেখায় ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত পাঠ থাকছে যা ক্ষেত্রবিশেষে “অকুপেশন ১০১” প্রমাণ্য চিত্রটির অনুলিখন। ফিলিস্তিনে ইহুদী উপনিবেশের ইতিহাস শুরুটা উনবিংশ শতকের শেষার্ধ থেকে। এ সময়ই ইউরোপে এন্টি-সেমিটিজম তথা ইহুদীবিদ্বেষ দানা বাঁধতে শুরু করে। আর ইহুদীরা নিজেদের একটি রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে শুরু করে। তাওরাতের প্রতিজ্ঞা মতে ফিলিস্তিনেই সেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা। তাওরাতে কোথাও বলা নেই যে, ফিলিস্তিনে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা ইহুদীদের জন্য আবশ্যক। শুধু এ ব্যাপারে ঈশ্বরের প্রতিশ্রুতির কথা আছে। কারণ খুব স্বাভাবিক, পয়পম্বর মূসা মিশর থেকে বনি-ইসরাইলদের বের করে নিয়ে এসেছিলেন ফিলিস্তিনে প্রত্যাবর্তনের উদ্দেশ্যেই, যদিও তার জীবদ্দশায় সে প্রত্যাবর্তন সম্ভব হয়ে উঠেনি। পয়গম্বর যীশুর সময় জেরুজালেমে ইহুদী রাজত্বই ছিল, খ্রিস্টান ধর্মমতে ইহুদীরাই যীশুকে শূলে চড়িয়েছিল। কিন্তু খলিফা উমরের রাজত্বকালে মুসলিমরা জেরুজালেম দখল করে এবং এখানে মুসলিম সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য পয়গম্বর মুহাম্মাদের সময় মদীনা থেকেও ইহুদীদের বিতাড়িত করা হয়। প্রায় সহস্র বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে ইহুদীরা বিতাড়িত ও ক্ষেত্রবিশেষে নির্যাতিত হলেও যেকোন যুক্তিবাদী মানুষ নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, এন্টি-সেমিটিজমের উত্থানের যুগে ফিলিস্তিনে ইহুদীদের কোন অধিকারই ছিল না। আমেরিকার সব মানুষই তো ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন ও পর্তুগাল থেকে এসেছে। তাই বলে এখন তো তারা এসব দেশে ফিরে যাওয়ার দাবী করতে পারে না। ১৮৭৮ সালের একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় ফিলিস্তিন মোটামুটি সমৃদ্ধ একটি দেশ হিসেবে বিরাজ করছিল এবং সেখানে মুসলিম ও খ্রিস্টানরা বেশ শান্তিতে বাস করছিল। সামান্য ইহুদীও ছিল। ১৮৭৮ সালে ফিলিস্তিনে জনসংখ্যার পরিসংখ্যান এরকম: মোট জনসংখ্যা – ৪৬২,৪৬৫ আরব মুসলিম এবং খ্রিস্টান – ৯৬.৮% ইহুদী – ৩.২% কিন্তু নেপোলিয়নীয় নীতির অনুসারী ব্রিটিশদের সহায়তায় ইহুদীরা বেশ দ্রুত ফিলিস্তিনে উপনিবেশ স্থাপন শুরু করে। জাহাজে করে একেকবারে হাজার হাজার ইহুদীকে ফিলিস্তিনে আনা হয়, ঘরবাড়ি করে থাকার জন্য তাদেরকে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেয়া হয়। সবাই জানেন, ইহুদীদের আর যাই হোক অর্থের সমস্যা নেই। এদের মধ্যে অনেকে আরবদের কাছ থেকে জমি কিনে নেয়, অনেকে জোরপূর্বক মুসলিম ও খ্রিস্টানদের ঘরবাড়ি দখল করে নেয়। ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের সহায়তার মূল কারণ ছিল- উসমানী খিলাফতের অধীনে থাকা ভূখণ্ডের ভাগ-বাটোয়ারা করার সময় মিশরকে নিরস্ত্র রাখা। ফিলিস্তিন ছিল মিশর নামক বোতলের ছিপি। ব্রিটিশরা ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছিল- এই ছিপি আটকে না দিলে মধ্যপ্রাচ্যের ভাগ-বাটোয়ারাতে জাতীয়তাবাদী মিশরীয়রা বাগড়া দেবে। উপনিবেশের স্রোতে ভেসে আসা ইহুদীদের পরবর্তী পরিসংখ্যান লক্ষ্য করা যাক- ১৯২২ সালের পরিস্থিতিটা এরকম: মোট জনসংখ্যা – ৭৫৭,১৮২ আরব মুসলিম এবং খ্রিস্টান – ৮৭.৬% ইহুদী – ১১% পরবর্তী পরিস্থিতির সাথে তুলনা করলে এই উপনিবেশ হারকেও কম বলতে হয়। আসলে ১৯৩৩ সালে হিটলারের ক্ষমতায় অধিষ্ঠানের পূর্ব পর্যন্ত মাথা ঠাণ্ডা রেখেই ইহুদী উপনিবেশের কাজ চলছিল। ১৯৩১ সালের পরিসংখ্যান: মোট জনসংখ্যা – ১,০৩৫,১৫৪ আরব মুসলিম এবং খ্রিস্টান – ৮১.৬% ইহুদী – ১৬.৯% এই প্রথম মানচিত্রের মাধ্যমে মুসলিম ও ইহুদীদের আবাসস্থল দেখাচ্ছি। প্রামাণ্য চিত্রটি থেকে স্ন্যাপশট নিয়েই এটা তৈরী করেছি: বলাই বাহুল্য হিটলারের অমানবিক ও সাইকটিক এন্টি-সেমিটিজম সব ইহুদীদেরকে ইউরোপ ত্যাগে বাধ্য করে। হিসাব খুব সোজা- বাঁচতে চাইলে ইউরোপ ত্যাগ নয়তো হিটলারের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাশবিক মৃত্যুবরণ। এই সুযোগে জায়নিস্টরা ফিলিস্তিনে ইহুদী উপনিবেশ দ্রুত বাড়াতে শুরু করে। পরিসংখ্যানই তা বলে দেয়। বিভিন্ন সময়ে ফিলিস্তিনে আসা ইহুদী অভিবাসী তথা উপনিবেশ স্থাপনকারীদের পরিসংখ্যান এরকম: ১৮৮২-১৯১৪ সালের মধ্যে – ৬৫,০০০ ১৯২০-১৯৩১ – ১০৮,৮২৫ ১৯৩৭-১৯৪৫ – ১১৯,৮০০ অর্থাৎ ১৯৩২ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে উপনিবেশ স্থাপনের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। এসময় পুরো বিশ্বের সহানুভূতি ছিল ইহুদীদের প্রতি। কিন্তু আজ পর্যন্ত অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী ও মানবতাবাদী সমাজকর্মী বলতে বাধ্য হয়েছেন- “হলোকস্ট তো হিটলার করেছে। এতে ফিলিস্তিনীদের তো কোন দোষ ছিল না। তাহলে ক্ষতিপূরণটা তাদেরকে দিতে হলো কেন?” মানবিক